মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২০ অপরাহ্ন
আমার সুরমা ডটকম : আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের কৃষক, ক্ষেতমজুরসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে খোলা আকাশে কাজ করে অভ্যস্ত। এদেশের মানুষের মধ্যে বজ্রপাত শব্দটা যদিও অতি পরিচিত, কিন্তু কখনো এটি আলোচনায় আসেনি। মানুষও কখনো এর ক্ষয়ক্ষতির দিকটি নিয়ে ভাবেনি। এর কারণ হলো, বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি অর্থাৎ মানুষের মৃত্যুর ঘটনাটা ছিল খুবই বিরল একটা বিষয়।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে, বিশেষ করে বছর তিনেক থেকে এটি ক্রমান্বয়ে আলোচনায় আসতে শুরু করেছে; যখন এর ব্যাপকতা বেড়েছে, অর্থাৎ এটাও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। চলতি বছরে ‘বজ্রপাত’ যেন একরকমের ভয়াবহ দুর্যোগরূপে আবির্ভুত হয়েছে। মানুষ অত্যন্ত আতংকিত হয়েছে পড়েছে। বিশেষ করে ক্ষেত-খামারে কাজ করা মানুষের মধ্যে ‘বজ্রপাত’ এক আতংক হিসেবে দেখা দিয়েছে। বৃহস্প্রতিবার সন্ধ্যায় মাত্র কিছুক্ষণ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে ৪১ জন এবং শুক্রবারও কম সময়ের মধ্যে আরো ২২ জন নিহত হওয়ার ঘটনা গোটা দেশকে নাড়া দিয়েছে।
বজ্রপাতে মৃত্যুর প্রবণতা বৃদ্ধি নিয়ে একেক জন একেক রকমের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইতিপূর্বে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা আলাদাভাবে সুনির্দিষ্ট করা হতো না। ২০১৩ সাল থেকে এর আলাদা হিসাব-নিকাশ ও মনিটরিংয়ের কাজ শুরু করেছে সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান কেন্দ্র। বেসরকারি একটি সংগঠন-‘দুর্যোগ ফোরাম’ও দেশে বজ্রপাতে নিহতের একটি হিসাব-নিকাশ দেখাচ্ছে। কিন্তু, এই দুর্যোগ ফোরামের হিসাব-নিকাশে অনেক গরমিল রয়েছে। ২০১৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে এই দুর্যোগ ফোরাম-এর বরাত দিয়ে বলা হয়েছিলো, বাংলাদেশে ২০১১ সালে ১৭৯ জন এবং ২০১২ সালে ১৫২ জন মানুষ বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন। অথচ আজই অর্থাৎ ১৪ মে, ২০১৬ প্রকাশিত দৈনিক সমকাল-এর এক প্রতিবেদনে একই সংগঠন- দুর্যোগ ফোরামের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে ৩০১ জন মানুষ বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন।
বজ্রপাতের স্থায়ীত্ব অত্যন্ত অল্প সময়ের। তাই সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, আপদ হিসেবেই দেখছে। তবে এ আপদ কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে সেই উপায়-পন্থা এখনো বের করা যায়নি। পূর্বাভাস দেয়ার মতোও কোনো প্রস্তুতি নেই সরকারের। আবহাওয়াবিদরাও একেক জন একেক কথা বলছেন। বলা হচ্ছে, কালবৈশাখির সম্ভাবনা থাকলে বজ্রপাতের আশংকা করা যেতে পারে। কালবৈশেখির আভাস পেলেই ঘন্টাখানেকের জন্য বজ্রপাতের পূর্বাভাস দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। যাতে মানুষ ওই সময়ের জন্য নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। কিন্তু, কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের কী সম্ভব এভাবে কাজ থেকে দূরে থাকা।
বজ্রপাত কেন হয়, এ নিয়েও রয়েছে নানা মত। এক সময় গ্রামে-গঞ্জে অভিশাপ হিসেবে দেখা হতো বজ্রপাতে মৃত্যুকে। মানুষ এটাকে স্বয়ং আল্লাহতাআলার সরাসরি শাস্তি হিসেবে মনে করতো। মিরজাফরের পুত্র মিরন বজ্রপাতে নিহত হওয়ার ঘটনাটি বহুল আলোচিত একটা ঘটনা। তখন বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা ছিলো এমনই নিতান্ত বিরল। সাধারণত মাওলানা-মৌলভীরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগকে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি আল্লাহর অসন্তুষ্টির প্রভাব হিসেবে বর্ণনা করে থাকেন। তারা বলে থাকেন, সমাজ ও রাষ্ট্রে যখন অন্যায়-অনাচার বেড়ে যায়,তখন আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে। অপরাধী-নিরপরাধ সবাই এর শিকার হন। এই শুক্রবারও অনেক মসজিদেই খুতবার আলোচনার বিষয় ছিলো বজ্রপাত। এ আপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মোনাজাত করা হয়।
দেশে সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর প্রবণতা কেন এভাবে বাড়লো, এ সম্পর্কে ধাতব দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি, বৈদ্যুতিক ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন প্রভৃতি নানা রকমের ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। বায়ুম-লে বাতাসের তাপমাত্রা ভূ-ভাগের উপরিভাগের তুলনায় কম থাকে। এ অবস্থায় বেশ গরম আবহাওয়া দ্রুত উপরে উঠে গেলে আর্দ্র বায়ুর সংস্পর্শ পায়। তখন গরম আবহাওয়া দ্রুত ঠা-া হওয়ায় প্রক্রিয়ার মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়।
কেউ কেউ বলেন, পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তি অক্ষুন্ন রাখার জন্য বজ্রপাত প্রাকৃতিক চার্জ হিসেবে কাজ করে। অন্য বিজ্ঞানীদের বক্তব্য-হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত বলেই বাংলাদেশকে বজ্রপাতপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চৈত্র-বৈশাখে কালবৈশাখীর সময়ে বজ্রপাতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে। এখন পর্যন্ত বজ্রপাত প্রতিরোধ বা এটাকে থামানোর কোন কৌশল বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারেনি। তবে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করে বজ্রপাত থেকে নিজেকে কিছুটা রক্ষা করা যায়।